সিকিমে, পাহাড়ের কোলে ছোট্ট দুই শহর, পেলিং ও রাভাঙলা

পেলিং থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা 

কাঞ্চনজঙঘা, এই পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম পর্বতশৃঙ্গ, ভ্রমণপীপাসু বাঙ্গালীর কাছে তীর্থক্ষেত্রের মতন। দার্জিলিং বা সিকিমে গিয়ে ভোররাত্তিরে শীতের কাঁপুনি তুচ্ছ করে, কাঞ্চনজঙঘা দর্শন করা এবং বাড়ি ফিরে এসে তার আশ্চর্য রূপের ভূয়সী বর্ণনা দেওয়া বাঙ্গালি ঘরে ঘরে পাওয়া যাবে।

এহেন কাঞ্চনজঙঘাকে যে সমস্ত জায়গা থেকে দেখা যায় তার অন্যতম হল পেলিং। সিকিমের পরিচিত টুরিস্ট স্পটগুলোর মধ্যে পেলিংএর অবস্থান কাঞ্চনজঙঘার সবথেকে কাছে। পশ্চিম সিকিমে অবস্থিত পেলিংকে বড় শহর বলা চলেনা। এই মফস্বল পাহাড়ী শহরের পরিবেশ গ্রাম্য, সাদামাটা অথচ সুন্দর এবং শান্তিদায়ক। 

পেলিংকে মূলত দু ভাগে ভাগ করা যায়। লোয়ার এবং মিডিল পেলিংএ স্থানীয় মানুষের বসবাস এবং দোকান, বাজার। আপার পেলিং টুরিস্টদের জন্য, হোটেল এবং রেস্তোরায় ভরা। আপার পেলিংএর শেষ প্রান্তে আছে একটা অতি মনোরম হেলিপ্যাড গ্রাউন্ড, যেটা হল পেলিংএর সানরাইজ পয়েন্ট। ভোরবেলা দেশী, বিদেশী পর্যটকরা এখানে ভিড় করে কাঞ্চনজঙঘার শরীরে আলোর খেলা দেখবে বলে। হেলিপ্যাড গ্রাউন্ডটার চারদিক খোলা হওয়ায় এখান থেকে হিমালয়ের পূর্ণ প্যানোরামিক ভিউ উপভোগ করা যায়।

পেলিং,পশ্চিম সিকিম 

 আকাশ খুব মেঘলা না থাকলে, প্রায় সারাদিনই পেলিংএর যেকোনো জায়গা থেকে কাঞ্চনজঙঘার ধবল চুড়া দেখা যায়। এখানকার বেশীরভাগ হোটেলের বারান্দা থেকে, এমনকি বেশ কিছুক্ষেত্রে রুমের বিছানা থেকেই প্রত্যক্ষ করা যায় ধবধপে বরফের চাদরে ঢাকা কাঞ্চনজঙঘাকে। একমাত্র সুর্যোদয়ের সময়ে কাঞ্চনজঙঘার সেই ধবল রূপ বদলে যায়। সদ্য উঁকিদেওয়া সূর্যের প্রথম আলোয় তার রং হয়ে যায় কমলা এবং অতি দ্রুত তা পাল্টে যায় সোনালীতে। এই কাঞ্চনবর্ণ কাঞ্চনজঙঘার রূপ লিখে বোঝানো অসম্ভব। যারা দেখেছে শুধু তারাই জানে।

সাতসকালে চা সহযোগে সর্গদর্শন, পেলিং ও কাঞ্চনজংঘা

হিমালয়ের অপরূপ এই পর্বতশৃঙ্গ দেখতে পাওয়া ছাড়াও পেলিং এবং তার আশপাশের অন্চল জুড়ে ছড়িয়ে আছে আরও অজশ্র প্রাকৃতিক সম্পদ। পেলিংএর পাশ দিয়ে বয়ে চলা রিমবি নদীকে আদর্শ পাহাড়ী নদীর তকমা দেওয়া যেতেই পারে। এই নদীর কাঁচের মতন সচ্ছ জল দীর্ঘদিন ধরে পালিশ করে চলেছে তার চলার পথের পাহাড়ী পাথরগুলোকে। এই নদীর অংশ হিসেবে আছে দর্শনীয় রিমবি জলপ্রপাত এবং কাঞ্চনজঙঘা জলপ্রপাত। যার মধ্যে কাঞ্চনজঙঘা জলপ্রপাত সিকিমের অন্যতম বড় জলপ্রপাত। রিমবি নদীর ধারে সিকিম সরকারের বানানো ওরেন্জ গার্ডেনটাও বেশ সুন্দর।

 রিমবি নদী, পেলিং

পেলিংএর মাত্র দু কিলোমিটার দুরে অবস্থিত পেমিয়াংসে মনেসটারি। 1705 সালে তৈরী সিকিমের অতি প্রাচীন এই মনেসটারির দেওয়াল জুড়ে রয়েছে অসংখ্য চিত্রকলা এবং বৌদ্ধ সন্তদের ভাস্কর্য। পেমিয়াংসের পাশেই দেখতে পাওয়া যাবে এই অন্চলের মূল আকর্ষণ, রাবদেনসে প্রাসাদের ধংসাবশেষ। 1670 থেকে 1814 অবধি সিকিমের দ্বিতীয় রাজধানি ছিল এই রাবদেনসে। পরবর্তীকালে গোর্খাদের আক্রমনে ধংস হয়ে যাওয়া এই প্রাসাদের ধংসাবশেষ সংরক্ষন করে পর্যটকদের জন্য খুলে দিয়েছে সিকিম সরকার।

পশ্চিম সিকিমের অন্যতম ল্যান্ডমার্ক শিংসোর ব্রীজ দেখা যাবে পেলিং থেকে 26 কিলোমিটার উত্তরে গেলে। এই ব্রীজ সিকিমের বৃহত্তম এবং এশিয়ার দ্বিতীয় উচ্চতম স্থানে অবস্থিত ব্রীজ হিসেবে পরিচিত।

শিংসোর ব্রীজ

পেলিং থেকে আনুমানিক 50 কিলোমিটার পূর্বে সিকিমের আরও একটা অতন্ত সুন্দর ছোট্টো পর্যটন কেন্দ্র রাভাঙলা। অর্কিড ও রডোডেনড্রনের শহর রাভাঙলা পাখিপ্রেমীদের জন্য আকর্ষনীয় জায়গা। পাখি সম্নদ্ধে জ্ঞ্যান থাকলে এবং ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে আপনি দেখা পেতে পারেন বিরল থেকে বিরলতম হিমালয়ান প্রজাতির পাখি।

রাভাঙলায় অবস্থিত বুদ্ধপার্ক এই অন্চলের সবথেকে বড় ক্রাউডপুলার। অত্যন্ত পরিপাটি করে সাজানো এবং রক্ষণাবেক্ষণ করে রাখা এই পবিত্র বৌদ্ধস্থান সজ্জিত রয়েছে অসংখ রংবেরংএর পতাকা দিয়ে।

বুদ্ধ পার্ক, রাভাঙলা

 রাভাঙলা পর্যবেক্ষণের শেষে টুক করে একবার টেমি টি গার্ডেন না দেখে এলে সেই ভ্রমণ অসম্পুর্ণ থেকে যাবে। রাভাঙলা থেকে 30 কিলোমিটার দক্ষিণে নামচি শহরে অবস্থিত এই টেমি টি গার্ডেন। সিকিমের এই একমাত্র চা বাগান সৌন্দর্যের দিক থেকে পূর্ব ভারতের অন্যতম। টি গার্ডেনের পাহাড়ি পথ ধরে নামতে নামতে দুর থেকে দেখতে পাওয়া গোলাপি চেরী গাছ, দিগন্ত বিস্ত্রিত সরু রাস্তা এবং চারিদিকে গুরুগম্ভীর পাহাড়ের সারি আপনাকে এক অন্য দুনিয়ায় এনে ফেলবে।

টেমি টি গার্ডেন, নামচি

টেমি টি গার্ডেন সংলগ্ন রেস্তোরা

লিখন: শুভদীপ চ্যাটার্জী