![]() |
চিত্র : ইন্টারনেট |
অনেক দিন পর উলুবেড়িয়া লোকালে উঠলাম। ভাইয়ের বিয়ে খেয়ে কলকাতা ফিরছি। ঠিকই শুনেছেন, ভাইয়ের। মামার ছেলে। আমাদের পুরো পরিবারে আমিই একমাত্র যে বিয়ে করেনি এখনো এবং ভবিষ্যতে করবো বলেও মনে হয় না। হ্যাঁ, আমি এখনো সিঙ্গেল এবং সেটা আমার কাছে বেশ গর্ব করার মত বিষয়। এই একটি বিষয়ে কেউ কোনোদিন আমাকে রাজি করাতে পারেনি মানে এখনো পর্যন্ত। সবাই হাল ছাড়লেও আমার মা এখনো বিশ্বাস করে, কোন না কোনোদিন আমি বিয়ে করবো। কারণ মা বিশ্বাস করে 'জন্ম মৃত্যু বিয়ে, তিন বিধাতা নিয়ে'। যাক ট্রেনে উঠে কেমন যেন নস্টালজিক হয়ে গেলাম। এই উলুবেড়িয়া লোকালে করেই আমি অফিস যাতায়াত করতাম যখন উলুবেড়িয়াতে থাকতাম।
সেই একইরকম ভিড়। হকারদের চিৎকার। 'ভালো ভালো মোজা আছে, বাচ্চাদের শীতের টুপি আছে, রুমাল আছে…' । হকারদের মুখগুলো সব চেনা। বেশ কিছু যাত্রীর মুখও চেনা। আজকে জানতে পারলাম 'শর্মার' নাম রূপা। ঘটনাটা একটু বলি। ফুলেশ্বর স্টেশনে ট্রেন ধরার জন্য অপেক্ষা করছি। উল্টো দিকের প্ল্যাটফর্ম থেকে চিৎকার 'ওই অপর্ণা চা খাবি?' অপর্ণাদি (ইনি একজন হকার, এই প্রথম এনার নাম জানতে পারলাম) চিৎকার করে বলল 'ট্রেন এসে যাবে আমি এই ট্রেনটা ধরবো' । উল্টো দিক থেকে আবার চিৎকার 'আরে, এই রকম ট্রেন কত আসবে কত যাবে, সারা জীবনই তো মাল বিক্রি করবি। এই শর্মা যত্দ্দিন বেঁচে আছে একটু মস্তি করে নে' । মনে মনে এই দিদির নাম দিলাম 'শর্মা'। খানিক হেসে অপর্ণাদি চা খেতে গেল শর্মাদির কাছে। অপর্ণাদির আর ট্রেন ধরা হল না। আজকে ট্রেনে অপর্ণাদি আর শর্মাদিকে একসাথে দেখলাম। ওদের কথা বার্তা শুনতে শুনতে শর্মাদির নামটা আবিষ্কার করে ফেললাম। সেদিনের ঘটনার পর থেকে, আমি, শর্মাদির একজন ফ্যান হয়ে গিয়েছিলাম।
![]() |
চিত্র : ইন্টারনেট (প্রতীকী ছবি) |
সাঁকরাইল স্টেশন থেকে উঠলাম। ভিড় ঠেলে একটা মোটামুটি নিরাপদ জায়গায় দাঁড়ালাম। ট্রেনে উঠে বসবার জন্য সিট আমি কোনোদিন খুঁজি না। যদি সিট আমাকে খোঁজে তখনই বসি। নিরাপদ বললাম কারণ ট্রেনে বসা এবং দাঁড়ানো নিয়ে গালাগালি, ঠেলাঠেলি ভালোই হয়। একদিন এরকম ঠেলাঠেলিতে একজন হাতের নখ দিয়ে গলায় আঁচড় দিয়েছিল আমার। তারপর থেকে ভিড় ট্রেনে উঠলে আমি বেশ ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে থাকি। আমার সন্ধানী চোখ চেনা মুখ খুঁজতে দৌড়া দৌড়ি শুরু করলো। বেশ কিছু চেনা মুখ চোখে পড়লো। এদের সাথে আগে কোনদিন কথা বলিনি। আজকেও বললাম না। তবে এদের দেখে মনটা খুশি হল। আমি বেশ খানিক মুখচোরা। দুমদাম কথা বলতে পারিনা কারো সাথে। আমি শুধু দেখি আবার কখনো দেখিও না শুধু শুনি। আর মনে মনে মানুষটা সম্পর্কে একটা ধারণা করতে থাকি। সুযোগ পেলে আমার ধারণার সাথে মানুষটাকে মেলানোর চেষ্টা করি। আর নাহলে কাল্পনিক একটা চরিত্র আমার মনে তৈরি হয়ে থাকে। আমার ভালো লাগে কল্পনা করতে। এইভাবেই কল্পনা করতে করতে এই কোলাহলে নিজেকে একা করে রাখতে পারি। একা থাকতে আমার ভালো লাগে।
![]() |
চিত্র : ইন্টারনেট |
সবাই মিলে কথা বললে করো কথাই শোনা যায় না স্পষ্ট। তবে কিছু কিছু সময় যায়। যেমন ধরুন কেউ কাউকে গালাগাল দিলে সেটা বেশ ভালোই শোনা যায়। কারণ সে সবার থেকে বেশি আওয়াজ করে শব্দটা উচ্চারণ করে। যাকে বলতে চাইছে তার মনযোগ আকর্ষণ করার জন্য। আবার ধরুন কারো সাথে হঠাৎ করে দেখা হয়ে গেছে ট্রেনে, তাই সে অনেক উত্তেজনার সাথে বলে উঠলো 'কি লো সুন্দুরী কেমন আছিস এবং …' । সেটাও শোনা যায়। কারণটা একই। যাকে বলছে তার মনযোগ আকর্ষণ করতে চায়। আবার, কেউ একজন অন্যজনকে খুব শিক্ষে দিচ্ছে। কারণ সে নিজেকে খুব জ্ঞাণী ভাবে। তাই সে অন্য কাউকে শিক্ষে দিলেও আর পাঁচজনও যাতে সেই শিক্ষে পায় এবং অন্যকে বেশ কিছু শুনিয়ে যে শান্তিটা পাওয়া যায় সেটার জন্য সে সবার থেকে বেশি আওয়াজ করেই কথা বলতে চায়। মানে, ওই সবার মনযোগ আকর্ষণ। আরেকজনের কথা আপনি শুনতে পারবেন যারা আপনার এক হাত দূরত্বে বা একদম পাশেই আছে তাদের কথা। এরকম বেশ কিছু ঘটনা আজকেও ঘটেছে। সেগুলোই বলবো।
![]() |
চিত্র : ইন্টারনেট (প্রতীকী ছবি) |
ঘটনা ১ :
ট্রেন ঢুকলো সাঁতরাগাছি স্টেশনে। এখানে অনেকেই নামে। ট্রেনের কামরা প্রায় অর্ধেক খালি হয়ে যায়। একটু লক্ষ করে দেখবেন প্রায় প্রত্যেক লোকাল ট্রেনের গেটে বেশ কিছু বিদ্বজ্জন মানুষ বসে বার্তালাপ করেন। যাত্রীদের বসার জন্য রেল কর্তৃপক্ষ যে ব্যবস্থা করেছেন, সেই ব্যবস্থা কে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ওনারা ট্রেনের কামরার গেট গুলোকে জবর দখল করেন। সাধারণত ওনারা বেশ মুখরা, সবজান্তা এবং ভাষা আবিষ্কারে বেশ দক্ষ হয়ে থাকেন। ওনারা নতুন শব্দের জন্ম দেন। বেশ কিছু শব্দ আমি আমার শব্দকোষে যোগ করে আমার শব্দকোষকে বেশ সমৃদ্ধ করেছি। এনাদের মধ্যে কেউ সব্জি বিক্রেতা, কেউ মাছ বিক্রেতা, কেউ লেদ কারখানার শ্রমিক আর domestic help (যাদের পোশাকি নাম কাজের মাসি)। সাঁতরাগাছি স্টেশনে ট্রেন থামতেই হুড়মুড়িয়ে লোকে নামছে। এদের বেশির ভাগই সরকারি বা বেসরকারি অফিসের কর্মী। এরা মানসিকতায় মধ্যবিত্ত। এদের ভীষন লোকলজ্জার ভয়। ফলে নামতে অসুবিধে হলেও গেটের বিদ্দোজ্জনদের মুখের ওপর কিছু বলতে পারে না। কিন্তু মনের ভিতর ভীষন রাগ। কিছু একটা করতেই হবে রাগ কমানোর জন্য। তাই তাদের কেউ কেউ ইচ্ছে করেই গেটে বসে থাকাদের ( লোকজন নামার সময় এরা দাঁড়িয়ে পরে) পা মাড়িয়ে দেয় বা কনুই দিয়ে গুঁতো মেরে নেমে যায়। এবং তারপর শুরু হয় খিস্তি খেউড়। তবে আজকের ঘটনাটা অন্যরকম। কেউ একজন গেটে বসাদের উদ্দেশ্যে খুব বাজে কিছু একটা বলে গেট থেকে নেমেছে। ট্রেন ছাড়লে একজন চিৎকার করে বলতে থাকলো 'মাগী এখন আয়া হয়েছিস বলে সিটে বসে যাচ্ছিস আর আমাদের গাল দিচ্ছিস। কি ভাষা! তুইও তো একদিন এই গেটে বসে যেতিস। মাগী ভদ্দরলোক হয়েছিস। এবং …' এর পরের শব্দগুলো নতুন (ওই যে বললাম শব্দ তৈরি করে) এবং কঠোর ভাবে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য।
ঘটনা ২:
মনে মনে বেশ আনন্দ হচ্ছে। নতুন কিছু শিখছি। ঠিক এই সময় পিছন থেকে চিৎকার। 'Bitch! Why don't you understand মেরে পাস প্যায়সা নেহি হ্যায়। দুসরে গেট মে মেরা ব্যাগ হ্যায় ভাইলোগোকে পাস। উসমে হ্যায় প্যায়সা! কাকিমা আমার কাছে'! বাংলা এই তিনটে শব্দ বলেই থেমে গেল। ভাবলাম, ঝগড়া বুঝি এবার ইংরেজি বা হিন্দিতে হবে। পিছনে তাকিয়ে দেখলাম একজন হকার আর একজন কলেজ পড়ুয়া (সম্ভবত)। হকার দিদির বয়স প্রায় ৫০ এর ওপরই হবে। হিন্দি বুঝলেও ইংরেজি বোঝে না। মেয়েটির হিন্দি আর ইংরেজি মিশিয়ে বলা কথার ওপর কিছু বলতেই পারছে না হকার দিদি। সম্ভবত ভাবছে কোন ভাষায় উত্তর দেবে। মনে মনে বললাম ভাগ্যিস 'Bitch' শব্দটার বাংলা জানে না। যদি জানত এতক্ষণে হাতাহাতি চুলোচুলি শুরু হয়ে যেত। মেয়েটি বেশ স্মার্ট । কারণ ও বুঝলো ইংরেজি বা হিন্দিতে বললে ও বেশ নিরাপদ। বাংলাতে বললেই ঝামেলা। তাই মাত্র তিনটে শব্দ বাংলাতে বলেই থেমে গেল। মেয়েটি বাঙালি বা অবাঙালি কিনা সেটা দেখে বুঝতে পারছি না। এখন বাঙালি চেনাটা কিছু কিছু সময় মুশকিল হয়ে যায়। কারণ এই জেনারেশন তিনটে ভাষাতেই বেশ সাবলীল। যদিও তাদের কোন ভাষাতেই ভালো দখল নেই। সেটা কথা বললে বুঝতে পারা যায়। একটা কোন ভাষা বলতে গিয়ে আটকে গেলে অন্য কোন ভাষা বলে বুঝিয়ে দেয়। আর পোশাকেও খুব একটা ধরা যায় না সবসময়। যাক, কিছুক্ষন ওদের কথাবার্ত ায় মনযোগ দিলে জানতে পারলাম আসল ঘটনাটা। মেয়েটির একটি মোজা পছন্দ হয়েছে। সেটিকে টেনেটুনে দেখার পর হকার দিদিকে ২০ টাকা দিয়েছে। কারণ মেয়েটি ভেবেছে এটার ২০ টাকাই দাম ( কিছু ক্ষন আগে শর্মাদি ২০ টাকায় বেচে গেছে) । কিন্তু এই হকারের কাছে ওই মোজার দাম ৩০ টাকা। আর মেয়েটির কাছে ৩০ টাকা নেই। ব্যাগ তোলপাড় করেও ১০ টি টাকা আর পাওয়া যাচ্ছে না। পাশে একজন বান্ধবী বসেছিল মেয়েটির। তার কাছ থেকে কেন হেলপ নিল না বোঝা গেল না। হকার দিদির বক্তব্য তুমি যেহেতু টেনেটুনে মোজা আমার বাড়িয়ে দিয়েছো আমি মোজা ফেরত নেব না। কথায় লজিক আছে। এদিকে ইংরেজি আর হিন্দিতে উত্তর না দিতে পেরে হকার দিদি মেয়েটির হাত থেকে মোজাটা কেড়ে নিয়ে অন্য দিকে চলে যায়। ফলে ঝগড়া প্রায় শেষের পর্যায়ে। কিন্তু প্রদীপ আবার জ্বলে উঠলো একজন বাঙালি যাত্রীর সহযোগিতায়। মেয়েটির প্রতিবেশী। বলে উঠলেন 'তুমি শিক্ষিত, ইংরেজি জানা মেয়ে। ও অশিক্ষিত হিন্দি ইংরেজি কিছুই জানে না। ওর সাথে কথা বলো না। তোমার কাছে টাকা না থাকলে কিকরে দেবে। ওদের ইদানিং বড্ডো বাড় বেড়েছে। কাস্টমারদের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় জানে না।' এটা শুনে হকার দিদি আবার চলে আসে। 'তুমি এত বলছো কেন? তোমার সাথে কি আমি কিছু বলেছি?' প্রতিবেশী বলে উঠলেন একটা মেয়ে হয়ে কি মেয়েকে সাপোর্ট করবো না? ব্যাস আরেক দফা শুরু হল ঝগড়া। হকার বনাম মেয়েটির প্রতিবেশী। পরিবেশ বেশ গরম। এরই মধ্যে মেয়েটি আরেকজন যাত্রীর কাছে ৫০ টাকার ডিজিটাল পেমেন্ট করে ক্যাশ টাকাটা হকার দিদির হাতে দিয়ে বলল দুটো মোজা দাও। হকার দিদি বললো 'আমি দেব না।'
ঘটনা ৩:
ট্রেন টিকিয়াপাড়ায় এসে বেশ কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে আছে। সবারই ভীষন বিরক্ত লাগছে। একজন মাথায় একটা বোঝা নিয়ে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থাকার পর গেটে বসা একজনকে জিজ্ঞাসা করলো 'সিংগেল দেছে?' উত্তর এলো 'সিংগেল দেয়নে। 'পিছন থেকে একজন বললো 'সিগনেল এখন দেখা যাবে নে। গাড়ি আরেকটু গেলে বোজা যাবে।' হাওড়া ঢোকার সময় এই সমস্যাটা প্রত্যেকটা ট্রেনের প্রত্যেকদিনের। প্ল্যাটফর্ম না পাওয়া পর্যন্ত ট্রেন প্লাটফর্মে ঢুকতে পারে না। আর প্ল্যাটফর্ম পেলে তখন সিগন্যাল দেয় ওই প্ল্যাটফর্ম থেকে। এখানে সেই সিগন্যাল এর কথাই আলোচনা করা হচ্ছে। 'সিংগেল' আর 'সিগনেল' শব্দ দুটো আমার শব্দকোষকে সমৃদ্ধ করবে।
ট্রেনের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে মনে হল সময়টা যেন থমকে গেছে। আজ প্রায় একবছর হয়ে গেল আমি এই ট্রেনে যাই না কিন্তু ট্রেনের ভেতরের পরিবেশ ঠিক একবছর আগের মতোই আছে। মনে হচ্ছে এ যেন কালকের ঘটনা। সময়ের স্বাভাবিক পরিবর্তন ট্রেনের ভেতরের পরিবেশকে ছুঁতে পারেনি। সেই একইরকম কোলাহল, মাসীদের কান গরম করা বার্ত ালাপ, হকারদের চিৎকার করে জিনিষ ফেরি করা 'ভালো ভালো কানের আছে, গলার হার আছে…'।
0 মন্তব্যসমূহ
আপনার মূল্যবান মন্তব্য আমাকে অনুপ্রাণিত করে !